![]() |
বদ্রিনাথ মন্দির |
পঞ্চপ্রয়াগ ছুঁয়ে বদ্রিনাথের পথে
হরিদ্বার থেকে শুরু করে দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ, নন্দপ্রয়াগ, বিষ্ণুপ্রয়াগ----এই পঞ্চপ্রয়াগের পথ ধরে গোবিন্দঘাট হয়ে পথ যাচ্ছে বদ্রিনাথ। যে পথে আমরা যাচ্ছি। আর এই গোবিন্দঘাট থেকে ঘাংঘারিয়া হয়ে অন্য একটি পথ চলে গেছে ফুলের উপত্যকা বা ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স আর শিখতীর্থ হেমকুন্ড সাহিব। গোবিন্দঘাট থেকে হেলিকপ্টার যাচ্ছে ঘাংঘারিয়া অবধি, তারপর হাঁটা পথ। আমরা এগিয়ে যাই বদ্রিনাথের দিকে। হরিদ্বার থেকে বদ্রিনাথের দূরত্ব প্রায় ৩২২ কিমি। উচ্চতা ১০,৪০০ ফুট। নীলকণ্ঠ পর্বতের ছায়ায় গড়ে ওঠা বিশাল বদ্রিনারায়ণ শহর। শহরের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত অলকানন্দা। মন্দিরের অবস্থানটি বড়োই মনোরম। মন্দিরের দুপাশে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে নর ও নারায়ণ দুই পর্বত, মাঝখান দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তুষারধবল নীলকণ্ঠ শৃঙ্গ। আর সামনে রোদ ঝলমলে আলোয় বিচিত্র রঙা বদ্রিনাথ মন্দির।
সূর্যোদয়ে নীলকণ্ঠ-শৃঙ্গ
ভোরের নরম আলোতে ঘুমন্ত নীলকণ্ঠের যা রূপ, তাঁর খাঁজের আনাচ কানাচ যতটা মায়াময়তা সৃষ্টি করে, সরাসরি সূর্যালোকে সেই ভাঁজ হারিয়ে যায়। ঘন কালো দুই পর্বতের ফাঁকে নীলাভ-শুভ্র নীলকণ্ঠ।যেন পর্বতরূপী নর-নারায়ণ ঋষি ধ্যানে বসে আছেন। বিশ্বচরাচরের সব বিষ পান করে শিব নীলকণ্ঠ হয়ে আছেন, জটাজুটধারী মহাদেব কণ্ঠে কালো বেড়! শহরের ভিড় থেকেই নীলকণ্ঠ দৃশ্যমান। সূর্যদেব তাঁর সাত ঘোড়ার রথ চালিয়ে প্রথমেই উপস্থিত হন এই নীলকণ্ঠ শৃঙ্গে।
বদ্রিনাথ মন্দির ও বিগ্রহ
প্রাচীন তীর্থক্ষেত্র ও ভারতবর্ষের অন্যতম বিষ্ণুমন্দির এই বদ্রিনাথ। মন্দিরের গঠনশৈলী অনবদ্য। সারা মন্দিরের কারুকার্যে রয়েছে নানা রঙের ছটা। কথিত আছে, আদি গুরু শঙ্করাচার্য মন্দিরের মূর্তিটি শালগ্রাম শিলা থেকে বানিয়েছিলেন। সমগ্র মূর্তিটি সোনায় মোড়া, ললাটে মূল্যবান হীরক বসানো। বদ্রিনাথের মন্দিরটি এখানকার রাজা প্রতিষ্ঠিত করেন ও পরবর্তীকালে ইন্দোরের রাণী অহল্যাবাই সংস্কার করেন ও চূড়া সোনায় মুড়ে দেন। অলকানন্দার বুকের উপর ব্রীজটা পার হয়ে ঘর-বাড়ির ভিড়ে বর্ণোজ্জ্বল মন্দির। মন্দির প্রবেশপথের সামনের দিকে সিঁড়ির নীচে রয়েছে সালফারের অনেকগুলি তপ্তকুন্ড---- নারদকুন্ড, সূর্যকুন্ড, ব্রহ্মকুন্ড, গৌরীকুন্ড। উষ্ণ প্রস্রবণে স্নান সেরে তুলসীপাতা দিয়ে পুজো দেওয়ার রীতি বদ্রিনারায়ণের। কাছাকাছির মধ্যে পঞ্চধারা, পঞ্চশিলা, শেষনেত্র, চরণপাদুকা ঘুরে নেওয়া যায়।
কেশবপ্রয়াগ ও মানা গ্রাম | Mana Gram , Badrinath , the last Indian Village
পুজো সেরে আমরা চলেছি পান্ডবদের মহাপ্রস্থানের পথে। বদ্রিনাথ থেকে কিছুটা এগিয়ে মানাগ্রামের পদতলে কেশবপ্রয়াগ। অলকানন্দা ও সরস্বতীর সংগমস্থল। অসাধারণ সুন্দর নদীসংগম। শান্ত , কোলাহলহীন কেশবপ্রয়াগ সবার অলক্ষ্যে রয়ে গেছে অপার সৌন্দর্য্য নিয়ে। বদ্রিনাথ থেকে মাত্র ৩ কিমি দূরে তিব্বত সীমান্তে ভারতের শেষ গ্রাম মানা। অষ্টবসুর তপোস্থলী থেকে বসুধারা কোটি জলকণা হয়ে নেমে আসছে, সেই ধারাকে বহন করে অলকানন্দা এই মানাগ্রামের নীচে সরস্বতীকে পাওয়ার জন্য ব্যস্তসমস্ত হয়ে দৌড়ে আসছে।
![]() |
বসুধারা জলপ্রপাত |
ভীমপুল পেরিয়ে বসুধারার পথে |Vasudhara water fall trek
লোহাপুল পার হয়ে অলকানন্দাকে ডাইনে রেখে ওপার দিয়ে পথ গেছে লক্ষ্মীবন হয়ে সতোপন্থ তালের দিকে। ওদিক থেকে বসুধারাকে দেখা যায় অলকানন্দার এপারে। আমরা যাচ্ছি বসুধারাকে ছুঁতে অলকানন্দাকে বাঁ-দিকে রেখে এপার দিয়েই। মানাগ্রামের অল্প ওপরে ভীমপুল। এখানেই অন্তঃসলিলা সরস্বতী নদীর উৎসস্থল। জলীয় বাষ্পের ধোঁয়া উঠছে। কথিত, দ্রৌপদীর নদী পারাপারের জন্য ভীম এই পাথর স্থাপন করেছিলেন। ভীমপুল পেরিয়ে এগিয়ে চলি। পথের পাশে ব্যাসগুহা ও গণেশগুহা। এখানে বসে ব্যাসদেব চতুর্বেদ রচনা করেন। আদি স্টেনোগ্রাফার স্বয়ং গনেশ তা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। মানাগ্রাম থেকে ৬ কিমি দূরে পবিত্র বসুধারা জলপ্রপাত। পুরোটাই পাথর দিয়ে বাঁধানো সহজ চড়াই পথ। চারপাশে মায়াময় , নিবিড়, গভীর , আশ্চর্য্য সৌন্দর্য্য। প্রায় ১২২ মিটার ওপর থেকে পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে জলধারা নেমে এসেছে। সূর্যালোকে রামধনুর সাত রং খেলে যায়। আরো এগিয়ে পথ গেছে সতোপন্থ হিমবাহ আর ভাগিরথী খড়ক হিমবাহের মিলনস্থলে যেখানে অলকানন্দার উৎসস্থল। আমরা বসুধারা থেকে ফিরে চলি।
চলবে....(to be continued)
পঞ্চপ্রয়াগ ছুঁয়ে বদ্রিনাথ, বসুধারার পথে- পর্ব ৩