![]() |
চৌকরি |
গন্তব্য চৌকরি | Destination Chaukori
এখন নভেম্বরের শেষ---- তাতে আবার বৃষ্টি! আশ্রম প্রাঙ্গণ ভিজে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, কালো মেঘের আড়ালে হিমালয়ের উপস্থিতি যেন লোপ পেয়েছে। আজ আবার লম্বা জার্নি, যাবো চৌকরি (Chaukori)। আশ্রমের ভারপ্রাপ্ত বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, "আপনাদের জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে আজকে না গেলেই নয়, থেকে যেতে পারতেন আজকে"। কিন্তু ওনাকে কি করে বোঝাই হাতে দিন গোনা। আজ এখানে থাকলে অন্য একটি জায়গা যাওয়া হবে না। তাই বৃষ্টি মাথায় বেরিয়ে পড়লাম। আটকে গেলেই মুশকিল।
আরও পড়ুন :
রানিখেত-শীতলাখেত-কৌশানি-বাগেশ্বর
ভারতের একমাত্র পার্বতী মন্দির বৈজনাথ | Parvati Temple at Baijnath
বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর একটা জিপ ভর্তি হল যাচ্ছে গরুড়। এই গরুড় উপত্যকাতে ভারতের একমাত্র পার্বতী মন্দির বৈজনাথ, কৌশানি থেকে দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। ক্যাত্যুরি বংশের রাজারা মন্দিরগুলির প্রতিষ্ঠাতা। কিংবদন্তি, শিব-পার্বতীর কনিষ্ঠ পুত্র কার্তিকেয় এই বৈজনাথেই সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। অতীতে নাম ছিল কার্তিকেয়পুর। তিনি ক্যাত্যুরি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। l-bhubaneswar মন্দিরে পার্বতীর মূর্তি ছাড়াও আছে শিব গণেশ লক্ষীসহ অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তিও। আমাদের ঠিক ছিল এখান থেকে যাবো বাগেশ্বর আর সেখান থেকে চৌকরি। কিন্তু কপাল ভালো হওয়ায় টানা চৌকরির বাস পেয়ে গেলাম।
বাগেশ্বর হয়ে চৌকরির পথে | Chaukori via Bageshwar .
বৈজনাথ থেকে বাগেশ্বর ২১ কিমি। বৃষ্টি কিন্তু হয়েই চলেছে। বাস ছাড়তে আধ ঘন্টা সময় নিল। এবার জানালার ধারে বসে শুধু অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা--- পাহাড়, নদী, ঘরবাড়ি, ছোট ছোট সাঁকো, বাজার এলাকা পার হয়ে আবার পাহাড়ি পথ। কোথাও কালো মেঘে ছেয়ে গেছে সামনের পথ দেখা যাচ্ছে না আবার কিছুটা গিয়ে পরিস্কার। দূরে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সাদা জমাট বাঁধা মেঘ। বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ের আলাদা একটা সৌন্দর্য্য আছে-- এতে বৈচিত্র্যময়ী পাহাড়ের রূপ যেন আরো বেড়ে যায়। বৃষ্টি-বিধৌত পাইন গাছগুলো কি ঝিলিক যেন খিলখিলিয়ে হাসছে। সাধারণ প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটক বা আধ্যাত্মিক-মনস্ক পর্যটক ছাড়াও বাগেশ্বর ট্রেকারসদের স্বর্গ। পিণ্ডারি-কাফনি, সুন্দরডুঙ্গা গ্লেসিয়ার দর্শনের জন্য ট্রেকপথ এখান থেকেই শুরু। সরযূর উপর সেতু পেরিয়ে আরো ৪৫ কিমি চৌকরি। এখন কোথাও কোথাও রোদের ঝিলিক দেখা যাচ্ছে, কিন্তু কিছুটা গিয়ে আবার মেঘলা। তবুও রোদের মুখ দেখতে পেয়ে মনটা নতুন আশায় নেচে উঠল।
সৌন্দর্য্যের নিকেতন চৌকরি
বাসে একজন ভদ্রলোক বললেন, মুন্সিয়ারিতে বরফ পড়ছে। শুনে মনটা ছটফট করে উঠল। আর ক-দিন পর আমরাও তো যাবো মুন্সিয়ারি! ভদ্রলোকটি আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, চৌকরিতে কি আমরা KMVN-এর লজ বুক করে যাচ্ছি। কোথাও কিছু বুক করা নেই জেনে উনি বললেন, ওনার একটি লজ আছে, সেখানে যদি আমরা থাকি? এখন তো অফ-সিজন, ভাড়াও কম। আমরা বললাম, ঠিক আছে গিয়ে যদি পছন্দ হয়, দেখবো। চৌকরি পৌঁছে বাস থেকেই উনি দেখালেন ওনার "Harsh Resort"----বাস থেকেই আমি লক্ষ্য করলাম লজটির একটা লন আছে যেখানে থেকে দূরের ঢেউ-খেলানো পাহাড় দেখা যায় আর এখন পাহাড়ের খাঁজে সাদা মেঘের জমাটি আসর বসেছে। কিন্তু এখান থেকে বরফশৃঙ্গ দেখা যায় না ঘরে বসে, তবে দু-মিনিটের সামান্য হাঁটা পথ।
KMVN-এর বাংলোর সামনে বাস নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। ভদ্রলোকটি আর কিছু না বলেই চলে গেলেন। কিন্তু আমার মন Harsh Resort-এই পড়ে রইল। Harsh Resort এর দিকে হাঁটা লাগালাম। গিয়েই দেখলাম সামনেই ওনার ছবি, ইনি একজন অবসরপ্রাপ্ত ফৌজি। মনটা ভালো লাগায় ভরে উঠলো। আসলে গাড়োয়ালের মস্তুরাতে ফৌজি চাচার হোটেলে থাকার অনন্য অভিজ্ঞতা ভোলার নয়। তাছাড়া হোটেলের লনটাও আমাকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করছিল।
এখানে শুধু আমরাই। উষ্ণ অভ্যর্থনায় মনটা ভরে উঠল। সামনে পাহাড়ের পর পাহাড়ের স্তর, ছবির মত সুন্দর। লনের নীচে স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা থাকে। এদের বাড়ি দূর গ্রামে তাই এখানে থেকে পড়াশোনা করে। বিকেলদিকে সামনের রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। দু-চারটে দোকান, হোটেল, স্কুল, পুলিশ-চৌকি, ডাকঘর নিয়ে চৌকরি খুবই ছোট জায়গা। আর তুহিন-কিরিটগুলিও এখন মেঘের আড়ালে। এখানে আমরা আগামীকালও থাকবো, যাবো পাতালভুবনেশ্বর দর্শনে। রাতের খাওয়া সাঙ্গ করে শুয়ে পড়লাম। ফৌজিদাদা বললেন যদি আকাশ পরিস্কার থাকে তাহলে তাড়াতাড়ি আমাদের তুলে দেবেন সূর্যোদয় দেখার জন্য নাহলে একটু দেরীতে চা এনে ডাকবেন।
পাতালভুবনেশ্বরে স্বর্গ দর্শন | Patal Bhuvaneshwar visit
আজও যথারীতি মেঘলা। যাবো পাতালভুবনেশ্বর। কাল দেখিনি আজ ব্যাগ খুলে দেখি জামা-কাপড় ভিজে। গতকাল বাসের মাথায় ব্যাগ তোলার জন্য এমন অবস্থা হয়েছে। কি করি , হোটেলের বারান্দায় রোদ্দুর আসতে চেয়ারের গায়ে, রেলিং-এ ভিজে জামা-কাপড় মেলে হোটেলের বাইরে দাঁড়াই গুপ্তরীর বাস ধরার জন্য। চৌকরি থেকে গুপ্তরীর দূরত্ব ৩০ কিমি। গুপ্তরী থেকে পাতালভুবনেশ্বর আরো ৮ কিমি। এই ৮ কিমি শেয়ার জিপ গেলেও এখন বিয়ের মরসুম বলে কিছুই পেলাম না। তাই একটা মারুতি ভাড়া করলাম।
কয়েকজন বয়স্ক মহিলা জীপের জন্য অপেক্ষা করছিল অনেকক্ষণ ধরে ওনাদেরও সঙ্গে নিলাম। ড্রাইভার নামিয়ে দেওয়ার পর বেশ কিছুটা রেলিং-এ ঘেরা পথ হেঁটে পৌঁছলাম গুহার সামনে। পরিবেশ শান্ত, স্নিগ্ধ। ঢোকার মুখে রেজিস্ট্রি খাতায় নাম-ঠিকানা লিখে, জুতো-ব্যাগ-ক্যামেরা জমা রেখে প্রবেশ মূল্য দিয়ে গাইডসহ নামতে হয় পাতালপুরী দর্শনে। ভেতরে আলোর ব্যবস্থা থাকলেও সঙ্গে টর্চ রাখা ভালো। সংকীর্ণ গুহাপথে লোহার চেন ধরে পাথরের ধাপে ধাপে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে প্রায় ত্রিশ ফুট নীচে নামতে হয়।
স্কন্দ পুরাণের মানসখন্ড থেকে জানা যায় অযোধ্যার সূর্যবংশীয় রাজা ঋতুপর্ণ মৃগয়ায় বেরিয়ে গুহাটি খুঁজে পান। পরবর্তীকালে আদি শঙ্করাচার্য নতুন করে গুহাটি খুঁজে পান ও শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করে পুজো শুরু করেন। নীচে বেশ প্রশস্ত চত্বর আর ভেতরটা বেশ গরম। জল জমে থাকায় পিচ্ছিল আর অমসৃণ। তাই একটু সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে। পাহাড়ের ফাটল বেয়ে জল চুঁইয়ে নেমে কখনও স্ট্যালাকটাইট অবস্থায় আবার কখনও স্ট্যালাকমাইট অবস্থায় একেক ধরনের প্রাকৃতিক ভাস্কর্য ও অবয়বের রূপ নিয়েছে। আলো-আঁধারির রোমাঞ্চকর পথে যেতে যেতে গাইডের বর্ণনায় কল্পনা রূপ পায় বাস্তবে। প্রথমেই নাগরাজ বাসুকির বিশাল ফণা, মেঝেতে সাপের দেহ, মুন্ডহীন গণেশের গলাতে উপরের পারিজাত বৃক্ষ থেকে জল ঝরে পড়ছে, দেওয়ালে গরুড়ের মূর্তি, বদ্রিনারায়ণ, কেদারনাথ, অমরনাথ শিবলিঙ্গ এবং ব্রহ্মা একসাথে বিরাজ করছেন। তাই পুরোহিত মহাশয় বললেন, সৃষ্টির আদিকালে সৃষ্ট এই পাতালভুবনেশ্বর দর্শন করলে নাকি চারধাম দর্শনের পুন্য অর্জিত হয়। পাপীরা নাকি পাতালভুবনেশ্বরে নামতে পারে না তাই অনেকে গুহামুখ পর্য্ন্ত এসেও ভয় পেয়ে ফিরে যায়।
চারটি পাথর----সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এবং কলিযুগ। কলি বাড়ছে ক্রমশঃ। কিছুটা এগিয়ে মহাদেবের জটা থেকে গঙ্গা নিঃসৃত হচ্ছে। কোথাও কালভৈরবের জিহবা, কোথাও জনমেজয়ের সর্পমেধ যজ্ঞকুন্ড, কামধেনু দেখতে দেখতে শিহরণ খেলে যায় সারা শরীরে। রামায়ণ-মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্র, তেত্রিশ কোটি দেবদেবী সকলেই হাজির এখানে। পঞ্চপান্ডবের পাশা খেলা, বহুপদ ঐরাবত কি নেই এখানে! এ এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। দুটি সুড়ঙ্গ দেখিয়ে পুরোহিত মহাশয় বললেন, একটি গিয়েছে বৃন্দাবন, অন্য একটি কেদারনাথ। তবে সাধারণ মানুষ এ পথে যেতে পারেন না। যাঁদের অতিলৌকিক ক্ষমতা থাকে তাঁরাই এপথে যেতে পারেন।
পরিস্থিতি এমনই যে কোন কিছুই এখানে অবিশ্বাস করতে মন চায় না---- বিশ্বাসেই তৃপ্তি, বিশ্বাসেই আনন্দ, বিশ্বাসেই সার্থকতা। সবশেষে পাতালভুবনেশ্বর শিবলিঙ্গের সামনে। তামা দিয়ে শিবলিঙ্গটি বাঁধিয়ে দেন শঙ্করাচার্য। এখানে নিত্য পুজো হয়। একঘন্টা পর আবার মর্ত্যে ফিরে আসি।কর্দমাক্ত হাত-পা ধুয়ে জিনিসপত্র ফেরৎ নিয়ে ফিরে চলি। এখান থেকেও দেখা যায় তুষারাবৃত শৃঙ্গরাজি। সঙ্গে গাড়ি থাকলে এখানে একদিন থাকাও যেতে পারে। ফেরার সময় গুপ্তরী থেকে বেরিনাগ এবং বেরিনাগ থেকে চৌকরির জীপ পেয়ে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ফেরার সময় দেখলাম মেঘেরা আসতে আসতে সরে যাচ্ছে। আশা করা যায়, আগামীকাল সূর্যোদয় দেখতে পাবো।
অবিস্মরণীয় সূর্যোদয়ের সাক্ষী | Sunrise from Chaukori
কাকভোরে ঘুম থেকে তুলে যেই ফৌজিদাদা বললেন, "বহিন-জি আজ একদম সাফ দিখ রাহা হ্যায়! আজ মওসম বহত প্যারা হ্যায়!'' চা-য়ে শেষ চুমুক দিয়ে কোনরকমে ছুটে যাই---- ত্রিশূল থেকে পঞ্চচুল্লি পর্যন্ত বিশাল রেঞ্জ ঝকঝক করছে। নরম গোলাপি আলোয় এক মায়াময় পৃথিবী, ভীষণ চুপচাপ শুধু পাখির কলতান। দূরে KMVN-এর ট্যুরিস্ট কটেজগুলো ছবির মত লাগছে, ও পাশে ঢেউ খেলানো উপত্যকা। আর কিছুক্ষণ পরই শুরু হল সূর্যের হোলি খেলা। চৌকরির উচ্চতা ৬৬৩৩ ফুট। চৌকরির ৩ কিমি আগে কোটমান্য, এখান থেকে হাঁটা পথে দেড়-কিমি চড়াই ভেঙে ৭৫০০ ফুট উঁচুতে দুষ্প্রাপ্য এবং দুর্মূল্য কস্তুরী মৃগের ফার্ম তথা রিসার্চ সেন্টার। অবলুপ্তির পথে চলে যাওয়া প্রাণীটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে এখানে। এখানে ফটো তোলা এমনকি জোরে কথা বলাও নিষিদ্ধ। এরা হৈ চৈ একেবারেই সহ্য করতে পারে না। পাশেই গান্ধি শিষ্য সরলাবেনের আশ্রম। কোটমান্য থেকেও তুষারধবল গিরিশৃঙ্গ খুব কাছ থেকে দৃশ্যমান। এখান থেকে যাবো বিরথি হয়ে মুন্সিয়ারি।
![]() |
কোটমান্য থেকে |
কিভাবে যাবেন | How to visit Chaukori
কাঠগোদাম/হলদোয়ানি থেকে বাস, শেয়ার জীপ, ভাড়া গাড়িতে আলমোড়া হয়ে চৌকরি। চৌকরি থেকে পাতালভুবনেশ্বর গাড়ি ভাড়া করে যাওয়াই ভালো।
কখন যাবেন | Best time to visit chaukori
সারা বছর যাওয়া যায় তবে বর্ষাকালে না গেলেই ভালো । ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি খুব ঠান্ডা থাকে, বরফ পড়ে।
কোথায় থাকবেন |
চৌকরি, পাতালভুবনেশ্বরে কুমায়ুন মন্ডল বিকাশ নিগম (KMVN) এর লজ আছে এছাড়া বেসরকারি হোটেল আছে।
প্রয়োজনীয় দূরত্ব | Distance between
- হলদোয়ানি থেকে চৌকরি ২২০ কিমি | Haldwani to Chaukori 220 k.m.
- আলমোড়া থেকে চৌকরি ১৩০ কিমি | Almora to Chaukori 130 k.m.
- কৌশানি থেকে চৌকরি ৮৪ কিমি | Kausani to Chaukori 84 k.m.
- চৌকরি থেকে পাতালভুবনেশ্বর ৩৮ কিমি | Chaukori to Patal Bhuvaneshwar 38 k.m.