কুমায়ুন হিমালয়ের জনপ্রিয় শৈলশহর নৈনিতাল। Nainital Travel Guide
সমগ্র কুমায়ুন জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য কিংবদন্তি। ভগবান বিষ্ণুর কূর্মাবতারের বাসভূমি কূর্মাচল, স্কন্দ পুরাণে উল্লিখিত কূর্মাচলই আজ কুমায়ুন। সেই রামায়ণ মহাভারতের যুগের কুমায়ুনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে হিন্দু পুরাণের নানান উপাখ্যান। রামায়ণে কুমায়ুনের নাম ছিল উত্তরকুরু আর মহাভারতে কিরাতভূমি। কুমায়ুনের পূর্বদিকে নেপাল, গাড়োয়াল আর মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে বয়ে চলেছে পুণ্যসলিলা কালীগঙ্গা নদী। কুমায়ুন হিমালয়ের বৃহত্তম ও সবচেয়ে জনপ্রিয় শৈলশহর নৈনিতাল।
তালের শহর নৈনিতালেরও মূল আকর্ষণ তার প্রকৃতি। সাত পাহাড়ে ঘেরা, সবুজে ছাওয়া নৈনিলেককে ঘিরেও অনেক কিংবদন্তি। নয়না পিকে চড়তে গিয়ে তিন ঋষি পুলহ, পুলস্থ ও অত্রি অত্যন্ত ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন। নিজেদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য নৈনিলেকের সৃষ্টি করেছিলেন। এই লেকে নাকি মানস সরোবরের জল মেলে। আবার দ্বিমতে, এটি একটি জাগ্রত সতীপীঠ। সতীর বাম নয়ন পড়েছিল এখানে। নয়ন থেকে নয়না আর তার থেকেই নৈনি নামের উৎপত্তি। লেকের শেষ প্রান্তে নয়নাদেবীর মন্দির।
এছাড়াও শহরে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ছোট বড় সরোবর। নৈনি লেককে ঘিরে আছে সাতটি পাহাড়, নাম তাদের---- আয়ারপাট্টা (ডরোথি সিট), দেওপাট্টা ( ক্যামেলস ব্যাক), হান্ডি-বান্ডি, চায়না বা নয়নাপিক, আলমা, লরিয়াকান্তা, শের কা ডান্ডা (স্নো-ভিউ-পয়েন্ট)। পাহাড়ের ধাপে ধাপে শহরের ঘর-বাড়ি। লেকে বাহারি সব বোট। লেকের জলে ভাসে সাত পাহাড়ের সবুজ আর আকাশের নীল প্রতিচ্ছবি। পপলার, দেওদার আর চিনার গাছে ছাওয়া সুন্দর সাজানো নৈনিতাল শহরটির বেশ বিদেশ বিদেশ ভাব।
নৈনিতাল কোন রাজ্যে অবস্থিত ।
সম্পর্কিত পোস্ট
মুন্সিয়ারি | Munsiyari A Paradise for Trekkers
জিম করবেটের নৈনিতাল
নৈনিতালেই জন্মগ্রহণ করেন বিশ্ববিখ্যাত শিকারি জিম করবেট। এখানকার মানুষের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কত হিংস্র বাঘকে মেরেছেন, সেসব শিকার কাহিনীর উপর লেখা তাঁর বই সারা বিশ্বে সমাদৃত। একদিকে তাল্লিতাল আর অপরদিকে মাল্লিতাল মাঝে দেড় কিলোমিটার ব্যাপী লেক। লেকের ধার দিয়ে সড়কপথ, ম্যাল রোডে জমজমাট দোকান, হোটেল, পর্যটকের ভিড়।
নৈনিতালে কাছাকাছির মধ্যেই দর্শনীয় স্থান | Nainital Sightseeing
ভেবেছিলাম আজকের বিকেলটা লেকের পাড় ঘেঁষে হেঁটে কাটাব কিন্তু ছবি হাতে এক ঘোড়াওয়ালার পীড়াপীড়িতে প্রথমেই গেলাম ল্যান্ডস-এন্ড, এখান থেকে পঞ্চভুজাকৃতি খুরপাতাল লেকটি দেখা যায়। লাভার্স পয়েন্ট, কামেলস ব্যাক ইত্যাদি গাড়িতে করে ঘোরার পর চেপে বসলাম ঘোড়ার পিঠে, উদ্দেশ্য ৪ কিমি দূরে ডরোথি সিট। গাছ-গাছালিতে ঘেরা, ইঁট বিছানো আঁকাবাঁকা সরু পাকদন্ডি চড়াই পথ দিয়ে গিয়ে পৌঁছতে হয় ডরোথি সিট। পথের মাঝে টিফিনটপে নামা যায়। এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। নৈনিলেকটিকেও সম্পূর্ণরূপে দেখা যায় এখান থেকে। ফেরার সময় আলোকমালায় সজ্জিত নয়নামাতার মন্দিরে আরতির ঘন্টাধ্বনি সাত পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয় আর সরোবরে আলোর চুমকি দেখে মনে হয় রাতের আকাশ যেন মর্ত্যভূমিতে নেমে এসেছে। রাতের নৈনিতালের রূপও মোহিনী। মন্দির লাগোয়া তিব্বতি মার্কেট। আজ তো হল না, আগামীকাল লেকের পাড় ধরে এক চক্কর হাঁটবো আর যাবো স্নো-ভিউ-পয়েন্ট।
ম্যাঙ্গো-পয়েন্ট ও স্নো-ভিউ-পয়েন্ট | Mango Point and Snow View Point
সকালের জলখাবার সেরে লেকের পাড় ধরে হেঁটে এখন পৌঁছেছি মাল্লিতালে রোপওয়ের টিকিট কাউন্টারের সামনে। নৈনিলেক আর শহরকে নীচে ফেলে ধীরে ধীরে উঠতে থাকি, মনে হচ্ছে নৈনিলেকের সবুজ জলে কে যেন আলপনা কেটেছে। ওপর থেকে নৈনিলেকটি আমের আকৃতির দেখতে লাগে বলে লেকটিকে ম্যাঙ্গো-লেক বা ভিউ-পয়েন্টটিকে ম্যাঙ্গো-পয়েন্টও বলে। পৌঁছে যাই স্নো-ভিউ-পয়েন্ট। এখান থেকে হিমালয়ের বিশাল রেঞ্জ চোখের সামনে উন্মুক্ত হয় যা পাহাড়ে ঘেরা শহর থেকে দেখাই যায় না। এখানে বাইনোকুলার বসানো রয়েছে। এছাড়াও নয়নাপিক , লরিয়াকান্তায় পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চেপে ওঠা যায়। পাহাড়গুলির মধ্যে নয়নাপিকের উচ্চতা সব চেয়ে বেশি।
![]() |
ম্যাঙ্গো পয়েন্ট থেকে নৈনিতাল |
নৈনিতাল লেক ট্যুর
সাততাল:- স্নো-ভিউ-পয়েন্ট থেকে ফিরে এসে দুপুরের আহার সেরে বেরিয়ে পড়ি লেক ট্যুরের উদ্দেশ্যে। নৈনিতাল বেশ জনপ্রিয় হানিমুন স্পট। প্রথমেই যাই ২১ কিমি দূরের সাততাল। তালগুলির নাম----রাম, লক্ষ্মণ, সীতা, ভরত, নল, দময়ন্তী, হনুমান ও গরুড়। লেকগুলি পরস্পর সংযুক্ত। তবে পরিস্কারভাবে সাতটি লেক বোঝা যায় না। লেকে বোটিং-এর ব্যবস্থা আছে । KMVN-এর ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউস আছে থাকার জন্য। ওক-পাইন গাছে ঘেরা এই সাততাল পরিযায়ী পাখিদের জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও বিভিন্ন পাহাড়ি পাখি, প্রজাপতি, কীটপতঙ্গ দেখার আদর্শ স্থান এই সাততাল।
এখান থেকে পরবর্তী দ্রষ্টব্য নওকুচিয়াতাল অর্থাৎ নয়টি কোণ বিশিষ্ট লেক, নৈনিতাল থেকে দূরত্ব ২৬ কিমি। ফিরে চলি হনুমানগড়ির উদ্দেশ্যে। হনুমানগড়ির খ্যাতি সান-সেট পয়েন্ট হিসেবে আর আছে হনুমানের বিশাল মূর্তি। এছাড়াও বৈষ্ণুদেবীর মন্দির উল্লেখযোগ্য। শেষ দ্রষ্টব্য নৈনিতালের বৃহত্তম লেক ভীমতাল। প্রত্যেকটি লেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আলাদা এবং অসাধারণ। ভীমতাল থেকে নৈনিতাল ২২ কিমি। নৈনিতাল থেকে বেশ কিছু রঙবেরঙের মোমবাতি কিনে নেওয়া যায় স্মারক হিসেবে যা ঘর সাজানোর জন্য বা উপহার দেওয়ার পক্ষেও খুব সুন্দর ।
প্যাঙ্গট:- লেক ট্যুরের সঙ্গে যোগ করে নেওয়া যায় ছোট্ট হিমালয়ান-হ্যামলেট প্যাঙ্গট, নৈনিতাল থেকে দূরত্ব মাত্র ১৫ কিমি। ৬,৫০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা প্রত্যন্ত এক গ্রাম প্যাঙ্গট যা পক্ষীপ্রেমীদের স্বর্গ। পাখি দেখতে হলে এখানে থাকতে হবে যদিও থাকার জায়গা খুবই কম। নাহলে সারাদিন সময় নিয়ে আসতে হবে, সেক্ষেত্রে একটা আলাদা দিন রাখতে হবে।
মুক্তেশ্বর:- শৈবতীর্থ মুক্তেশ্বরের জনপ্রিয়তা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের জন্যই। পরিস্কার, মেঘমুক্ত দিনে এখান থেকে আকাশজুড়ে তুষারশৃঙ্গের শোভা মুগ্ধ করে। নৈনিতাল থেকে মুক্তেশ্বরের দূরত্ব ৫২ কিমি। মুক্তেশ্বরের মূল দ্রষ্টব্য মুক্তেশ্বর মহাদেব মন্দির আর 'চৌলি কি জালি'। মন্দিরের পিছনের রাস্তা দিয়ে অল্প হাঁটা পথ চলে গেছে একটু উঁচু আর ফাঁকা স্থানে। যেখান থেকে পুরো মুক্তেশ্বর উপত্যকার দৃশ্য অপূর্ব লাগে। এখান থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্যও মনোরম। এখানেই খাদের ধারে পাথরের গায়ে বিরাট আকৃতির ছিদ্র দেখা যায়। নিয়মিত হাওয়ার ধাক্কায় পাথর ক্ষয়ে এই ছিদ্র বা জালির সৃষ্টি হয়েছে । এটাই 'চৌলি কি জালি'। মুক্তেশ্বরের উচ্চতা ৭,০০০ ফুট।
জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক | Jim Corbett National Park
নৈনিতাল থেকে করবেট ন্যাশনাল পার্ক ঘুরে নেওয়া যায়। নৈনিতাল থেকে রামনগরের দূরত্ব প্রায় ৬৬ কিমি। রামনগর বাসস্ট্যান্ডে KMVN-এর ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউস। পাশেই বনদপ্তরের অফিস। জঙ্গল সাফারির জন্য এই অফিস থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে হয়। অনলাইনে আগে থেকেও সাফারির জন্য বুকিং করে নেওয়া যায়। আগে থেকে বুকিং করা থাকলে বা ডিএফও অফিস থেকে অনুমতি পাওয়া গেলে থাকা যায় জঙ্গলের একেবারে গভীরে কোর-এরিয়ায়-- ধিকালা, বিজরানি এবং গৈরিলা বনবাংলোতে।
কলকাতা থেকে নৈনিতাল কিভাবে যাবেন | How to visit Nainital.
হাওড়া-লালকুঁয়া সুপার ফার্স্ট এক্সপ্রেসে (সাপ্তাহিক) লালকুঁয়া স্টেশন অথবা হাওড়া-কাঠগোদাম বাগ-এক্সপ্রেসে কাঠগোদাম বা হলদোয়ানি স্টেশন। কাঠগোদামের ৫ কিমি আগে হলদোয়ানি, এখান থেকে বাস/শেয়ার জিপ পেতে বেশি সুবিধা হয়।
অন্যপথে যে কোন ট্রেনে লক্ষ্ণৌ পৌঁছে, লক্ষ্ণৌ থেকে ২ কিমি দূরে আইসবাগ স্টেশন।
আইসবাগ থেকে মিটারগেজ শাখায় আইসবাগ-লালকুঁয়া-নৈনিতাল এক্সপ্রেসে পরদিন সকালে লালকুঁয়া। লালকুঁয়া থেকে কাঠগোদামের দূরত্ব ২২ কিমি, হলদোয়ানির দূরত্ব ২৭ কিমি। লালকুঁয়া/কাঠগোদাম/হলদোয়ানি যে কোনো স্টেশন থেকে বাস, শেয়ার জিপ, ভাড়া গাড়িতে নৈনিতাল।
লেক-ট্যুর, সাততাল বা প্যাঙ্গটের জন্য গাড়ি ভাড়া করতে হবে।
নৈনিতাল থেকে সকালে একটি বাস যায় মুক্তেশ্বর। হলদোয়ানি থেকে মুক্তেশ্বর ৭২ কিমি।
নৈনিতাল থেকে রামনগর যাওয়ার জন্য বাস, শেয়ার জিপ পাওয়া যায়। দিল্লী থেকে ট্রেনে সরাসরি পৌঁছনো যায় রামনগর।
নৈনিতাল দেখার সেরা সময | Best time to visit nainital.
নৈনিতাল যাওয়া যায় সারা বছর।
সাততাল, প্যাঙ্গট ঘোরার উপযুক্ত সময় মার্চ-এপ্রিল।
মুক্তেশ্বর ঘোরার আদর্শ সময় অক্টোবর থেকে এপ্রিল।
জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জুনের মাঝামাঝি খোলা থাকে।
কোথায় থাকবেন | Hotels at nainital.
নৈনিতাল, সাততাল, মুক্তেশ্বর, রামনগর সব জায়গাতেই KMVN-এর ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউস ছাড়াও প্রাইভেট হোটেল রিসর্ট আছে। প্যাঙ্গটে থাকার জায়গা খুবই কম। দু-একটি কটেজ আছে। ধিকালা, বিজরানি, গৈরিলাতে বনদপ্তরের বাংলো আছে।
প্রয়োজনীয় দূরত্ব| Distance between
- নৈনিতাল থেকে কাঠগোদাম ৩৪ কিমি. nainital to kathgodam 34 k.m.
- নৈনিতাল থেকে সাততাল ২১ কিমি. nainital to sattal 21 k.m.
- নৈনিতাল থেকে প্যাঙ্গট ১৫ কিমি. Nainital to Pangot 15 k.m.
- নৈনিতাল থেকে মুক্তেশ্বর ৫২ কিমি. Nainital to Mukteshwar 52 k.m.
- নৈনিতাল থেকে রামনগর ৬৬ কিমি. Nainital to Ramnagar 66 k.m.